Thursday, September 4, 2025
HomeScrollFourth Pillar | অনিল আম্বানিকে জেলে ঢোকালে মোদি সরকার পড়ে যাবে?

Fourth Pillar | অনিল আম্বানিকে জেলে ঢোকালে মোদি সরকার পড়ে যাবে?

সামাজিক রাজনৈতিক বিরোধিতায় নামা মানুষেরা জেলে পচবে আর জালিয়াতরা টাকা মেরে আরামসে জীবন কাটাবে জেলের বাইরে

এক্কেবারে সামনে কমবেশি ১৬০০ কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগ, হ্যাঁ এক্কেবারে লিখিতভাবেই এসবিআই আর ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অভিযোগ করেছে। সেই অভিযোগে জালিয়াতি, ফ্রড শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। ১৬-১৮ কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগে যে ইডি, সিবিআই কাউকে মাসের পর মাস জেলে পুরে দেয়, সেই ইডি বা সিবিআই কিন্তু অনিল আম্বানিকে জেলে পুরছে না, কারণ খুব সোজা, জেলে পুরলেই সরকার পড়ে যাবে। হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে বড় আম্বানি, মানে দাদা মুকেশ নাকি প্রায় ১৫০ জন সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই চলছেন, সুতোয় ঝুলছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। হ্যাঁ, সেই জন্যই এই ধারণার জন্ম হয়েছে যে কোনওভাবে এই হাজার হাজার কোটি টাকার স্পষ্ট প্রতারণার অভিযোগের পরেও কিন্তু অনিল আম্বানিকে জেলে ঢোকানোর সাহস দেখাতে পারছেন না আমাদের নীতি নৈতিকতার বুলি কপচানো নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। একথা তো সত্যিই যে ভারতের বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত বৈষম্য সর্বদা চোখে পড়ে। একদিকে রয়েছেন রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান অনিল আম্বানি, যিনি দেশের দুটো বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক— স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) এবং ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (বিওআই)-এর মতো প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত। অভিযোগ গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাইরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়েতে তাঁকে দেখা গেছে, দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে, বিদেশও ঘুরে এসেছেন কয়েকবার, না, তাঁকে পুলিশ বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এখনও গ্রেফতার করেনি।

অন্যদিকে, দিল্লি দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রনেতা উমর খালিদ গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিনা বিচারে তিহার জেলে বন্দি রয়েছেন। দুটো ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন, কিন্ত প্রশ্ন তো থেকেই যাবে যে আমাদের বিচার ব্যবস্থা কি সকলের জন্য সমানভাবে কাজ করে? ভারতের আইন ব্যবস্থা কি সত্যিই ক্ষমতার ভারসাম্য অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে, নাকি এর পিছনে আছে কিছু জটিল আইনি ও পদ্ধতিগত কারণ, যা সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের ইতিহাস আজকের নয়, দীর্ঘদিনের। তবে এই ক’দিন হল নতুন অভিযোগ এসেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) আর ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (বিওআই) থেকে। এই দুটো ব্যাঙ্কই তাদের দেওয়া ঋণের হিসাবগুলোকে ‘ফ্রড’ বা জালিয়াতি হিসেবে ঘোষণা করেছে। এসবিআই-এর অভিযোগ, রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস বা আরকম এবং অনিল আম্বানি ২৯২৯.০৫ কোটি টাকার আর্থিক প্রতারণার সাথে জড়িত। ঋণের শর্ত লঙ্ঘন করে এই টাকা অন্যান্য কোম্পানি বা রেলেভ্যান্ট স্টেকহোল্ডারদের, ‘সংযুক্ত পক্ষ’দের পাওনা মেটাতে ব্যবহার করা হয়েছে। একইভাবে, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াও আরকম-এর প্রাক্তন পরিচালক অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে ৭২৪.৭৮ কোটি টাকার বকেয়া ঋণের জন্য একই অভিযোগ এনেছে। বিওআই-এর মতে, ২০১৬ সালে রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস-কে দেওয়া ৭০০ কোটি টাকার ঋণের প্রায় অর্ধেক এক ফিক্সড ডিপোজিটে বিনিয়োগ করা হয়েছিল, যা ঋণের শর্তের পরিপন্থী ছিল। এই ধরনের কার্যকলাপকে ব্যাঙ্কগুলো ‘ফান্ড ডাইভারশন’ বা তহবিলের অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর সিবিআই অনিল আম্বানির বাসভবন এবং রিলায়েন্স কমিউনিকেশনসের অফিসগুলোতে তল্লাশি চালায়।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে ভারত?

কিন্তু না, অফিসে ডেকে ৪৬-৫২ ঘণ্টা জেরার পরে যেমনটা জানানো হয় যে আপনাকে গ্রেফতার করা হল, তা কিন্তু এখানে হয়নি। এরকম আর কোনও দৃষ্টান্ত আমাদের জানাই নেই। কেন গ্রেফতার করা হল না? কে জিজ্ঞেস করবে? মিডিয়া? তারা এখন রাহুল গান্ধী কেন ভোট চোর বললেন? কাকে বললেন? এরকম বলাটা উচিত হয়েছে কি না? এতে করে ভারতের গণতন্ত্রের কী কী ক্ষতি হচ্ছে তা বোঝাচ্ছেন। কিন্তু কেন হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতারণার অভিযোগে অনিল আম্বানিকে গ্রেতার করা হল না, সেই প্রশ্ন তুলে ধরেননি। এর একটাই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে, তা হল সরকার পড়ে যাওয়ার ভয়েই অনিল আম্বানিকে গ্রেফতার করার সাহস দেখাতে পারছে না ইডি বা সিবিআই। হয়তো আর ক’ বছরের মধ্যে এই অভিযোগের আর কিছুই পড়ে থাকবে না। মুছেই যাবে সব ঋণের হিসেব নিকেশ। গত ১০ বছরে ভারতের তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো ১৬.৩৫ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ রাইট-অফ করেছে, যার মধ্যে ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ আর্থিক বছর পর্যন্তই প্রায় ৯.৯ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ রাইট-অফ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ যখন ছোট ঋণের জন্য ব্যাঙ্ক ও প্রশাসনের দরজায় বার বার ধাক্কা খান, তাঁদের ছোট্ট ঋণ আদায়ের জন্য যখন সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ, তখন বড় শিল্পপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণকে ‘রাইট-অফ’ হতে দেখে তাদের মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, আইন ও ব্যবস্থা কেবল ধনীদের পক্ষেই কাজ করে। স্বচ্ছতার অভাব, আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং অভিযুক্তের গ্রেফতার না হওয়া, স্বাভাবিকভাবেই এই জনক্ষোভকে আরও তীব্র করে তোলে। অন্যদিকে দেখুন, চোর নয়, জোচ্চোর নয়, খুন বা ধর্ষণের অভিযোগ নেই কিন্তু উমর খালিদকে ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গার ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারার, দাঙ্গা, খুন, বেআইনি সমাবেশ, পাশাপাশি সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর আইন Unlawful Activities (Prevention) Act (UAPA)-এর অধীনেও অভিযোগ আনা হয়েছে।

ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত হওয়ার পর তাঁকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি তখন থেকেই জেলে রয়েছেন। আর ইউএপিএর মজাদার নিয়মই হল— ‘জেলই নিয়ম, জামিন ব্যতিক্রম’। এই আইনের ধারা ৪৩ডি(৫) অনুসারে, যদি আদালত পুলিশের জমা দেওয়া কেস ডায়েরি বা রিপোর্ট দেখে মনে করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ‘প্রাথমিকভাবে এক সত্য মামলা’ (prima facie true case) আছে, তবে আদালত জামিন দিতে বাধ্য নয়। এক্ষেত্রে ‘প্রাথমিকভাবে সত্য’ হওয়ার অর্থ হল, আদালতকে প্রমাণের বিশদ বিশ্লেষণ করতে হবে না, শুধু পুলিশের রিপোর্টে থাকা তথ্যের ভিত্তিতেই সন্তুষ্ট হলেই চলবে। এবারে দেখুন অনিল আম্বানির মামলা আর্থিক জালিয়াতির আইনি কাঠামোর মধ্যে পড়ে, আমার আপনার টাকা গায়েব করেছে রিলায়েন্স কমিউনিকেশন। অন্যদিকে, উমর খালিদের মামলাতে কী আছে? কোন প্রমাণের ভিত্তিতে তিনি জেলে? কেউ জানে না। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে থাকার পরেও তাঁর বিরুদ্ধে মূল মামলার বিচার শুরু হয়নি । সুপ্রিম কোর্টে তাঁর জামিনের আবেদন বারবার পিছিয়ে গেছে। বিচারকদের নিজেদের সরিয়ে নেওয়া, আইনজীবীর অনুপস্থিতি এবং সময়ের অভাব— এসব কারণে শুনানি পিছিয়ে চলেছে। অনিল আম্বানি যদিও এখনও দেশেই রয়েছেন, কিন্তু তাঁর মতো প্রভাবশালী আর্থিক অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। দেশের সরকার কি তাহলে সেই মহান পলায়নের জন্য অপেক্ষা করছে? এই মামলাগুলো থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট, বড় আর্থিক অপরাধীরা কেবল দেশীয় আইনি কাঠামোর দুর্বলতা ব্যবহার করে না, বরং বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে এক দেশের আইনি প্রক্রিয়া থেকে আর এক দেশের আইনি প্রক্রিয়াতে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে আইন ও বিচার পদ্ধতির পার্থক্য এই অপরাধীদের জন্য আইনি লড়াইয়ের সুযোগ তৈরি করে দেয়। সম্ভবত সেরকম কোনও মেগা সিরিয়াল এপিসোড দেখার জন্যই বসে আছেন ভারতবাসী।

এটা তো পরিষ্কার যে একটা হল অর্থনৈতিক অপরাধ, অন্যটা প্রমাণ ছাড়াই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত অপরাধ। আর এই দুই ধরনের অপরাধের জন্য আইন ভিন্ন, বিচার প্রক্রিয়া ভিন্ন এবং জামিনের শর্তও ভিন্ন। এই ভিন্নতা তো আমাদের জানা কিন্তু আইনের চোখে কি সবাই সমান? সেটাও তো একই বিবেচনার মধ্যেই রাখতে হবে। উমর খালিদকে জেলে পুরে রাখলে সরকার পড়ে যাবে না তাই তিনি জেলেই পচবেন আর অনিল আম্বানিকে জেলে পুরলেই সরকার পড়ে যাবে তাই তিনি জেলের বাইরেই দিব্য জীবন কাটাবেন? প্রভাবশালী আর্থিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতাবান মানুষজনদের জন্য আইনি প্রক্রিয়াটি হঠাৎই উবে যায়, যেখানে সাধারণ নাগরিকদের জন্য তা কঠোর ও দ্রুত কার্যকর হয়। কারণ? এই বৈষম্য কেবল আইনি বা পদ্ধতিগত নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে এক গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। ভারতের বিচার ব্যবস্থা, যা সংবিধানের অধীনে সবার জন্য সমান বলে বিবেচিত, ক্ষমতা ও প্রভাবের সঙ্গে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, এই দুটো ঘটনা তার এক স্পষ্ট উদাহরণ। দুটো ঘটনাকে সামনে রেখে আমাদের তো প্রশ্ন করতেই হবে যে, আমরা কেমন সমাজ গড়তে চাই— যেখানে আইনের চোখে সবাই সমান, নাকি যেখানে ক্ষমতার ওজন অনুযায়ী বিচারের পাল্লা নড়েচড়ে বসে? তার জবাব মেলাটা আজ খুব জরুরি। না হলে সামাজিক রাজনৈতিক বিরোধিতায় নামা মানুষেরা জেলে পচবে আর জালিয়াতরা টাকা মেরে আরামসে জীবন কাটাবে জেলের বাইরে।

Read More

Latest News